আবুলের বাপ ও অলৌকিক ব্যাঙ্ক।
বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী ও উড়ন্ত ঘোড়ার আবিষ্কারক ডঃ আবুল অন্য সবার মতোই ব্যাঙ্কে টাকাকড়ি রাখেন। আবুলের বাপ ছিলেন নিতান্ত সাধারণ চাষী। পুরোনো আমলের লোক হিসেবে তিনি ব্যাঙ্ক পছন্দ করতেন না। পরে ডঃ আবুল যখন বিশ্বজোড়া নাম-ডাক পেয়ে বছরের দশমাস বিদেশে ঘুরতে লাগলেন তখন তিনিই জোর করে বাপের নামে একাউন্ট খুলিয়ে দিলেন। কিছুদিন পরেই আর কারো কোনো আপত্তি রইল না।
একদিন আবুলের বাপ গেছেন ব্যাঙ্কে টাকা তোলার জন্যে। দরজার সাইনবোর্ড দেখে তিনি বেজায় অবাক হয়ে গেলেন। ব্যাঙ্কের নামের আগে ?অলৌকিক? কথাটা জুড়ে গেছে। (মানে অলৌকিক সুইস ব্যাঙ্ক টাইপের নাম)। চিন্তা করতে করতে তিনি ভিতরে ঢুকলেন। ঢুকেই দেখেন দেয়ালে মোটা করে লেখা আছেঃ-
?টাকা তুলিতে আসা ব্যক্তিরা দাঁড়াইয়া থাকিবেন?
আবুলের বাপের চিন্তা বেজায় বেড়ে গেল। ভাবতে ভাবতে তিনি কাউন্টারের কাছে গিয়ে দেখেন সেখানে লেখা আছে
?টাকা তুলিবার জন্য তাড়া দিবেন না। সঠিক সময়ে পাইবেন।?
তার তলাতেই লেখাঃ
?টাকা গুনিয়া দেখা নিষেধ?
এমন আজব কারবার দেখে আবুলের বাপ প্রায় দিশেহারা হয়ে গেলেন। গ্রামের নিতান্ত সাধারণ মানুষ হয়ে এইসব পরিবর্তনের তিনি কোনো থই করে উঠতে পারলেন না। অবশেষে সাহস করে কাউন্টারে প্রশ্ন করলেন, ?ভাই, এসব কি হয়েছে??
কাউন্টারের ভাই গর্বিতভাবে বললেন ?সব অলৌকিক! আপনি যদি বেশি কিছু জানতে চান তবে ম্যানেজার অথবা মালিকের কাছে প্রশ্ন করুন।?
ম্যানেজার এর কামরায় গিয়ে আবুলের বাপ আরোই অবাক হলেন। ভিতরে যাওয়া মাত্রই ম্যানেজার এক আজব কায়দা করে মাথা নাড়িয়ে তাঁকে স্বাগত জানালেন। বললেন, ?বসুন। বলুন আপনার জন্য কি করতে পারি?
আবুলের বাপ- ?আপনারা এত সব নিয়ম পাল্টালেন কেন? আগের নিয়মে কি সমস্যা ছিল??
ম্যানেজার- দেখুন, আগের চেয়ে এই নিয়ম ভালো। কারণ আগের গুলো মানুষের তৈরী ছিল। এগুলো সব অলৌকিক নিয়ম।?
আবুলের বাপ- ?ব্যাঙ্কেও অলৌকিক নিয়ম??
ম্যানেজার- কেন? আপনি কি অলৌকিক বিশ্বাস করেন না? যদি বিশ্বাস করেন তবে তো এগুলো সেই অলৌকিক থেকেই এসেছে বলে আপনি মানতে বাধ্য।?
আবুলের বাপ- এই নিয়মে চলতে আমার সমস্যা আছে। আমি অন্য ব্যাঙ্ক দেখব।
ম্যানেজার- আপনি এসব কি বলছেন? আমাদের নিয়মে চলে দেখুন। এই নিয়ম আপনাদের ভালর জন্যেই তো করা হয়েছে। আপনি সেটা বুঝার চেষ্টা করছেন না কেন? আপনি এই নিয়ম মেনে চলুন, তবেই না সেটা বুঝবেন।
আবুলের বাপ এই কথা শুনে বেজায় ঘাবড়ে গেলেন। তাঁর স্বাভাবিক বুদ্ধি বলছে যে এইসব নিয়ম কোনোভাবেই অলৌকিক হতেই পারে না। কিন্তু গ্রামের মূর্খ চাষী হয়ে ম্যানেজারের সাথে তর্ক করার ক্ষমতাও তাঁর নেই। কাজেই তাঁকে টাকা তুলতে গেলে অপেক্ষা করতে হবে কখন ব্যাঙ্কের সময় হয়। তারপর সেই টাকা না গুনেই বাড়ি চলে যেতে হবে। এমন বিটকেল ব্যাঙ্কে তাঁর টাকা রাখতেই ইচ্ছা করছিল না। ফলে অগতির গতি হিসাবে তিনি মোবাইল বের করে পুত্র ডঃ আবুলের নম্বর ডায়াল করলেন। এরপর ডঃ আবুল এর সাথে ম্যানেজারের কথাবার্তা চলল।
আবুল- ম্যানেজার স্যার, আপনি ব্যাঙ্কের নিয়ম বদল করলেন বেশ কথা। কিন্তু সেই নিয়মে ভালো চলছে সেটা কিভাবে বুঝলেন?
ম্যানেজার- সার, আমনে আমাত্তে বেশি বুঝেন? আমনে কি ব্যাঙ্কিং লাইনের লোক?
আবুল- না, বেশি বুঝি না। আপনি আমাকে বোঝান ত। টাকা তোলার সময় গুণে নিলে সমস্যা কি?
ম্যানেজার- মালিক বলেছেন যে অলৌকিক ব্যাঙ্কের ভুল হতেই পারে না। তাই টাকা গুনে দেখার দরকার নেই। গুনে দেখলে যদিও বা কোনোভাবে কম হয় তবে সেটা কাস্টমারের গোনার ভুল। তাকে আবার গুনতে হবে, তাতেও না হলে আবার গুনতে হবে। যতক্ষণ না মেলে গুনতেই হবে। তাই আমরা গুনতে মানা করি।
আবুল- আর টাকা নেবার সময়ে আপনারা কি করেন?
ম্যানেজার- দেখুন, মানুষের ভুল হতেই পারে। তাই আমরা গুনে নিই।
আবুল- আচ্ছা, আপনাদের কাছে টাকা তোলার সময় দেরী করান কেন?
ম্যানেজার- দেরী করাই বললে ভুল হবে। আমরা সঠিক সময়েই সব কাজ করি। আপনি নিশ্চয় জানেন যে অলৌকিক ব্যাঙ্ক ভুল করতেই পারে না।
আবুল- আপনাদের ব্যাঙ্কে টাকা রাখলে কি কি সুবিধা আছে?
ম্যানেজার- আমাদের ব্যাঙ্ক সবার সেরা স্যার। সব রকম সুবিধা পাবেন।
আবুল- তবু দু একটা শুনি। ধরুন হাজার টাকা ডবল হয় কত বছরে?
ম্যানেজার ? সেটা স্যার সঠিক বলা যাবে না। মালিক যেটা ভাল মনে করবেন সেটাই হবে। তবে তিনি যা করবেন তাতে খারাপ কিছু হবে না এটা নিশ্চিত জানবেন। অলৌকিক ব্যাঙ্ক কোনোদিন খারাপ কিছু করতেই পারে না।
আবুল- আচ্ছা এবার শেষ প্রশ্ন। টাকা রাখার পরে কিছুই ফেরত না পাওয়া যেতে পারে কি?
ম্যানেজার- অবশ্যই তেমন সম্ভাবনা আছে স্যার। মালিক যদি মনে করেন তবে কিছুই না দিতেও পারেন।
আবুল- আচ্ছা, আপনার চেয়ে ভালো ব্যাঙ্ক নেই এটা কিভাবে জানলেন? আপনি আর কোনো ব্যাঙ্কে কাজ করেছেন?
ম্যানেজার ? অলৌকিক ব্যাঙ্ক যেকোনো মানুষের ব্যাঙ্কের থেকে ভালো। এতে সন্দেহ করার কিছু থাকতেই পারেনা। কেন অন্য ব্যাঙ্কের সাথে তুলনা করেন?
আবুল- ঠিক আছে। আপনার ব্যাঙ্ক সবার সেরা। কিন্তু আমার পছন্দ নয়। আমরা মানুষের ব্যাঙ্কেই টাকা রাখব। আপনি একাউন্ট ক্লোজ করে দিন।
ম্যানেজার- এটা তো সম্ভব নয় স্যার। কারো একাউন্ট ক্লোজ করলে অলৌকিক ব্যাঙ্কের নিয়ম ভাঙা হবে। এতে বিশ্ব অর্থনীতির সর্বনাশ হয়ে যাবে। এমনটা কিছুতেই সম্ভব নয়।
এইবার আবুলের সেই চেহারা দেখা গেল, যার জন্য আবুলের বাপ তাকে ছেলেবেলায় হারামজাদা ডাকতেন। বাঘা গলায় আবুল বললেন। শোনেন ম্যানেজার! পনের মিনিটের মধ্যে আপনি পুরো টাকা তুলে গুণে দিয়ে হিসাব বন্ধ করুন। না হলে এখান থেকে একটা ফোন করলে আপনার পিঠে যা পড়বে তার হিসেব অলৌকিক খাতায় কুলোবে না। আবুল কি জিনিস সেটা না জানা থাকলে এই সময়ের মধ্যে জেনে নিতে পারেন।
ফোন রেখে ম্যানেজার আরেকটি নম্বর ডায়াল করে সমাচার শোনালেন। আবুল কি জিনিস তা এক মিনিট শূনেই তাঁর মুখ সাদা হয়ে গেল। মাথার চুল খাড়া হয়ে উঠল। অজ্ঞান হয়ে গদাম করে চেয়ার সমেত উলটে পড়লেন ম্যানেজার। লোকজন দৌড়ে এল। মিনিট পাঁচেকের চেষ্টায় তিনি আবার উঠে চেয়ার দখল করলেন।
চেয়ারে গুছিয়ে বসেই ম্যানেজার বলনেন ?আপনি কি ভেবেছেন আমি অজ্ঞান হয়ে গেছিলাম? মোটেই না, আমি অলৌকিক মালিকের সাথে কথা কইলাম। তিনি বললেন আপনি একাউন্ট বন্ধ করতে পারেন। এতে বিশ্ব অর্থনীতির ক্ষতি যা হবে তা উনি সামলে দেবেন। আপনি প্লিজ আপনার ছেলেকে বলে দিন। আর ইয়ে, ভয় পেয়েছি বলে মনে করবেন না।।?
টাকাকড়ি বুঝে নিয়ে আবুলের বাপ বের হয়ে গেলেন। ম্যানেজার তাঁকে দরজা অবধি এগিয়ে দিয়ে কামরায় ফিরে এলেন। সেখানে বসে তাঁর চোখমুখ লাল হয়ে গেল, মাথার চুল খাড়া হয়ে গেল। রাগে গজগজ করে বলতে লাগলেন
ক্র্যাশ হোক আবুলের প্লেন। আর সে আফ্রিকার জঙ্গলে পড়ুক। নরখাদকের হাতে বন্দী হোক। তাদের আগুনে পুড়ে কাবাব হোক। তার হাড্ডি দিয়ে বাঁশি বানানো হোক। তার মুন্ডু নিয়ে জংলীরা ফুটবল খেলুক.........
আস্তে আস্তে তাঁর ভাষা আরো উন্নত হতে থাকল। এদিকে তাঁর স্টেনোগ্রাফার নোট বই বের করে সেসব লিখে নেওয়া শুরু করে দিল।